জীবনকে দেখা, তার অভিজ্ঞতা একেকজনের একেকরকম হয়। এটাই স্বাভাবিক। আবার সেসবের প্রকাশভঙ্গি, বাচন তারও রকমফের থাকে বৈকি! প্রণম্য কথাসাহিত্যিকেরা প্রায় সকলেই যেমন লেখায় বা সৃষ্টিতে নিজস্ব শৈলীর স্বতন্ত্র পরিচয় রেখেছেন, তেমনই আবার সেসবের গঠনগত দিক দিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছু নিয়ম মোটামুটি মেনে চলেছেন। তবু ভাষার রীতি, প্রয়োগ, শব্দবন্ধ যুগে যুগে বদলেছে। আবার অনেক সময় এই বদল নিয়েও যথেষ্ট কথা ওঠে, সমালোচনার ঝড় উঠে যায়।
এইরকমই এক আগলভাঙা, আটপৌরে আড্ডার ভাষায় বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে প্রায় অচেনা ধরনের এক জীবনযাত্রার কথা বছরকয়েক আগে ফেসবুকের পাতায় হঠাৎই দেখা যেতে লাগল। যেমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার চমকে দেওয়া সব কাহিনি, তেমনই তার পেশকারি! যে সদ্য তরুণ ঘরের খেয়ে পাড়ার রক বা চায়ের দোকানের বেঞ্চ গরম করে তুমুল আড্ডা দিতে ভালোবাসে, নাটক করতে ভালোবাসে প্রাণ দিয়ে, চুটিয়ে প্রেম করছে ভালোবাসার মেয়েটির সঙ্গে, তাকে কেন নির্বান্ধব প্রত্যন্ত জঙ্গলে বা দূরে কোথাও যেতে হবে ‘নোকরি’ করতে? কেন পদে পদে অন্যের আদেশে নানা বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে? বড় কঠিন ব্যাপার! প্রেম করেছ, বিয়ে করতে হবে, তাই চাকরিও করতেই হবে—এ কেমন আবদার? হ্যাঁ, এটা বোঝা যেমন একপক্ষের জন্য কঠিন, তেমনই অন্যপক্ষের তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোও সমান কঠিন। আর নোকরি বা চাকরির জগতে এক অলিখিত কিন্তু চালু শর্ত হল, “নোকরি না করি। করি তো ‘না’ না করি।” চাকরি না করাই সবচেয়ে ভালো। কিন্তু করতে হলে কোনো কিছুতে ‘না’ বলা চলবে না।
জমজমাট আড্ডাখানা, নাটকের দল, মিষ্টি প্রেমিকা, সব ছেড়ে হঠাৎ গিয়ে পড়তে হল এমন জায়গায়, কালচে সবুজ পাতায় ভরা ঘন জঙ্গল যেখানে ছোটানাগপুর রেঞ্জের অটল পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে নিজের গাঢ়ত্বে ডুবে রয়েছে, দামোদর বা অন্য পাহাড়ি নালা তার কোল ছেড়ে খেলা করতে করতে ঝিরঝির করে বেরিয়ে এসেছে। সরলমতি নিষ্কলুষ হরিণ যেখানে নির্ভয়ে চরে বেড়ায় বা খাঁড়ির আড়ালে ছায়ামাখা গাছতলায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে। কথা বলার জন্য মনের মতো লোক নেই, আড্ডা তো দূর। বইপত্র, খবরের কাগজ, নাটক, বন্ধুবান্ধব, ‘সে’... কিছুই তো নেই! শয়ে শয়ে নিষ্পাপ গাছ টাঙ্গির কোপে শুইয়ে ফেলা হচ্ছে ভবিষ্যতের উন্নয়নের স্বার্থে। প্রতিবাদ শুনবার কেউ নেই। কাজ করতে হচ্ছে অবাঙালি এক মনুষ্যত্ববোধহীন অফিসারের আদেশের অধীন হয়ে, যিনি নাকি এমএসসি পাশ করেছেন ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে, ব্যাডমিন্টন খেলায় ইউনিভার্সিটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তিনি কলকাতায় ‘পেলে’ খেলতে আসছে শুনে প্রশ্ন করেন “পেলে ক্যায়া চিজ হ্যায়?” হতাশায়, নিষ্ফল আক্রোশে নির্জন জঙ্গলে বা পাহাড়ি নালার ধারে একাকী চিৎকার করে ওঠা বা হাউহাউ করে কেঁদে ওঠা ছাড়া আর কোনো পথ পায় না মানুষটা।
আছে তো আরো অনেক কাহিনি। শিকার হয়ে যাওয়া হরিণের কাজলকালো চোখ থেকে গড়িয়ে আসা জল, সদ্য বিবাহিত বৌকে নিয়ে রাতের জঙ্গল জিপে পাড়ি দিতে গিয়ে ডাকাতদলের হাতে পড়া ও অলৌকিকভাবে উদ্ধার পাওয়া, পালামৌয়ের জঙ্গলভরা গঞ্জে দেহাতি আর আদিবাসী প্রান্তিক জনেদের মাঝে হিন্দিতে এগারো ঘণ্টা ধরে আশ্চর্য নাটক করা, মাটির নীচে কালোহীরার রাজ্যে অন্ধকার খনির অলিগলিতে ঘোরার রোমাঞ্চ, মাত্র কয়েক বছরে উনিশবার এই ক্যাম্প সেই ক্যাম্পে বদলি, অনভিজ্ঞতায় দুটি বিশাল মাপের হাঁড়ি-কড়াই, একটি স্টোভ আর তার পিন কিনেই সংসার পাততে বসে যাওয়া—এইরকম অজস্র ঘটনার দৈনন্দিনী। আর রয়েছে নানারকম মানুষ, অমানুষ, না-মানুষ দেখার ও চেনার কাহিনি। এই সবই বলা হয়েছে পুরো আড্ডার মেজাজে। তাতে আছে লেখকের নিজস্ব শব্দভাণ্ডারের তাক লাগানো সব শব্দবন্ধ, যেমন, ল্যাবলা ফুসফুস, ফুটিতে গুড়, কেলেঙ্কারিয়াস ল্যাক্টাভেরিয়াস, খাটিয়া খাড়ি বিস্তারা গোল, ফুটুর ডুম, ফুস্স্স্ ইত্যাদি।
দু’টি মানুষ—কবি ও প্রাবন্ধিক দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য ও প্রয়াত নাট্যকার অমিতাভ চক্রবর্তীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়—যাঁরা আড্ডার মধ্যেই এইসব কাহিনি আড্ডার ভাষায় শুনে ক্রমাগত উৎসাহ ও তাগাদা দিয়ে গেছেন এগুলিকে ছাপার অক্ষরে সবার সামনে হাজির করার জন্য, যাতে সবাই এর স্বাদ পান। প্রসঙ্গত, আমি নিজেও এইরকমই জীবন কাটিয়েছি বলে এই পাঁচালি ও তার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে পেরেছি প্রথম পর্ব থেকেই। দীর্ঘসময় এই বন্ধুলেখকের সঙ্গে এক ছাউনির তলায় (‘ছাদের তলার’ সুযোগ ছিল না ফিল্ড লাইফে) কাটিয়ে তাঁর অননুকরণীয় বলার ঢংটিও চেনা হয়েছে। এটুকু বলতে পারি, যাঁরা এইরকম জীবন কাটানোর কথা শোনেননি বা ভাবতে পারেন না, তাঁরাও এই লেখার বৈচিত্র্য, আটপৌরে ভাষার অকপট সহজতা, অনবদ্য শব্দবন্ধে মুগ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত না পড়ে ছাড়তে পারবেন না। ও হ্যাঁ, এই খণ্ডে কিন্তু ‘নোকরি’ পর্ব সবটা আঁটানো যায়নি। আরো অনেক বৈচিত্র্যভরা পথ চলার কাহিনি রয়ে গেছে পরের খণ্ডের জন্য, যার ইঙ্গিত লেখক দিয়েই রেখেছেন। অলমিতি—
অলোক কুমার চক্রবর্তী
Nokri
Affordable PBB