প্রেমচন্দ
![](https://static.wixstatic.com/media/a40ef3_c89c3f1ae2f84b708fec26e7239cabdb~mv2.jpg/v1/fill/w_95,h_125,al_c,q_80,usm_0.66_1.00_0.01,blur_2,enc_auto/a40ef3_c89c3f1ae2f84b708fec26e7239cabdb~mv2.jpg)
স্কুলের সিলেবাসে আমরা সকলেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "দুই বিঘা জমি" কবিতাটা পড়েছিলাম। উপেনের সঙ্গে হওয়া অমানবিক অন্যায়, এবং শেষ পরিণতিতে জমিদারের দেওয়া 'চোর' অপবাদের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। আজকে যার সাথে আমরা পরিচয় করব সেও এই উপেক্ষিত আর অত্যাচারিতদের দলেরই একজন। গল্পটির পটভূমিকা--সামন্ততান্ত্রিক শাসন।
কালজয়ী লেখক, প্রেমচন্দের এই "সোয়া সের গম" (सवा सेर गेहूँ), গল্পটাতে একদিকে রয়েছেন ঠাকুরমশাই--ভূস্বামী, যিনি গল্পের ও সময়ের ক্রম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে ওঠেন মহাজন, আর অন্যদিকে হারান--যে চাষী থেকে হয় মজুর, সঙ্গে আছে তার পরিবার--যারা শুধুমাত্র উপেক্ষিত নয়, তারা যেন ভূস্বামীর নিজের সম্পত্তি ও হাতের পুতুল। গল্পে এতটুকু (সোয়া সের) গম ধার করার জন্য ভূস্বামীর চোখ রাঙানি ও শাসিতের কুণ্ঠার টানাপড়ে্নে উঠে এসেছে তদানীন্তন সামন্ততান্ত্রিক ভারতের কদর্য এবং অসহনীয় রূপ।
ঠাকুরমশাইয়ের চরিত্র, বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি যেকনো সামন্তপ্রভুর মতোই লোভী, ধূর্ত, সুবিধাবাদী, এবং মনের দিক দিয়ে অত্যন্ত খারাপ--এক কথায় পাষণ্ড। তবে ঠাকুরমশাইয়ের ব্যাবহারের নিরিখে হারানকে পুরপুরি চেনা দায়, হারানকে চিনতে গেলে আমাদের নিজেদের চরিত্রের দিকেও তাকাতে হয়, যেমন ভয় পেয়ে যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা--এটা হারানের মত আমাদেরও গতানুগতিক জীবনের অনুষঙ্গ!
গল্পটা শুরু হয়েছে হারানের ভগবানের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের সাক্ষী রেখে। তবে এই ভগবানে বিশ্বাসটা ঠিক কতখানি হারানের নিজের ভয়কে আড়াল করার জন্য তৈরি আর কতটা ভগবানের প্রতি আত্মনিবেদন, সেটা কিন্তু গল্পে ক্রমশ প্রকাশ্য। এছাড়াও গল্পের ঠিক মাঝামাঝিতে, ঘটনাবলির স্রোতে আমরা একটা প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়াই--আমরা যে উপার্জন করি সেটা ঠিক কার জন্য করি? নিজেদের ভালো থাকার জন্য; নাকি নিজেদের প্রিয় মানুষদের জন্য ...
যদিও প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনা। হারান তার মহাজনী ভয়কে খানিক কাবু করলেও গল্পের পরিনতি অত্যন্ত মর্মান্তিক। গল্পের সেশে লেখক হারানের সম্পর্কে বলেছেন, "... সে বেচারা চাষী। চাষীর ধার সারাজীবনের,"--সার কথা--ওই সুবিধাবাদী মহাজনী যুক্তির মারপ্যাঁচে জড়িয়ে পড়া যেন হারানের মতো যেকোন শোষিতের একমাত্র ভবিতব্য।
যদিও হারান কিন্তু বেশিরভাগ শাসিতদের মতো নয়, সে নিজেকে এখনো পুরোপুরি বিকিয়ে দেয়নি, সামাজিক অবস্থানের কুণ্ঠা আর মহাজনী ভয়ের বাইরে সে একটা সরল জীবনের দাবিদার, সে পরিবার নিয়ে ভালো থাকতে জানে। লেখকের কলমের জোরে হারানের এইটুকু চাওয়া আর তার চেয়েও অনেকটা কম পাওয়ার অঙ্ক; আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একটা শক্তিশালী চপটাঘাত, এখন আমরা নিজেরা নিজেদের অজান্তেই ইঁদুর দৌড়ে নাম লিখিয়েছি, জীবনকে উপেক্ষা করে শুধুই ছুটে চলেছি, কিসের ভয় আমাদের, বা কি চাই আমাদের--ঠিক বুঝতে পারছিনা। আজকে অবশ্যই সময়ের পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু এখনো সম্ভবত আমরা ভেবে দেখার সময় সুযোগ পাইনি--আমরা কিসের জন্য কাজ করি, নিজেদের ভালো রাখতে? না শুধুমাত্র অন্যদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করে দিতে? আমরা ভেবে দেখি না কাজের পরিবর্তে আমরা টাকা পেলেও জীবনটা উপভোগ করার মতো সময় ও সুযোগ আদৌ পাচ্ছি কি না।
যাই হোক, হারানের পরিণতি শুধু হারানে সীমাবদ্ধ নয়, হারানের মতো তার ছেলে কানাই বা রবীন্দ্রনাথের উপেনও একই সমাজব্যবস্থার শিকার। আজকে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হলেও সুবিধাবাদী মানসিকতার পরিবর্তন হবে কি? ইদানিং একদল মানুষ ধনী থেকে আরো ধনী হয়ে চলেছে, আর একদল সব খুইয়ে টেনেটুনে কোনরকমে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় জীবন অতিবাহিত করছে। তাহলে কি মানব সমাজের খোলস ছাড়া আদতে কিছুরই পরিবর্তন হয়নি? প্রশ্ন আসে--কিসের পরিবর্তন? কিসের পরিবর্তন কাম্য--সমাজ ব্যবস্থার নাকি মানুষের নিজের মানসিকতার?
মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের দুটো লাইন,
"এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি"
(দুই বিঘা জমি)
লোভী রাজা না থাকলেও, রাজত্বের মানসিকতা আজও রয়ে গেছে ...
এবার আসা যাক গল্পের অনুবাদে। আসল গল্পটি প্রেমচন্দ লিখেছিলেন হিন্দিতে। যে প্রচ্ছদটি এখানে দেওয়া হয়েছে, সেটি সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ। অনুবাদ অত্যন্ত সাবলীল, পড়ার সময় কখনো মনে হবে না যে এটির ভাষান্তর করা হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে জগদীশ যোশীর আঁকা ছবিগুলো, যেগুলো এই মর্মস্পর্শী গল্পকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
বইটা আপনি কলেজস্ট্রিটে এন.বি.টি-র দোকানে পাবেন।
দাম - ১১ টাকা।