সত্যজিৎ রায়ের প্রিয় ‘শাঁটুলদা’ (মানিকবাবুকে শার্লক হোমস ধরে নিলে, শাঁটুলবাবুকে আড়ালে থাকা মাইক্রফ্ট বলে ধরে নেওয়াই যায়!) ওরফে শ্রী রাধাপ্রসাদ গুপ্ত সাকুল্যে তিনটি বই লিখেছিলেন। ২০০০ সালে প্রকাশিত তাঁর এই শেষ বই ‘স্থান কাল পাত্র’-র আখ্যাপত্রেই লেখক ঘোষণা করেছেন: “তথ্য নহে, তত্ত্ব নহে এ খলু সংসারে সাময়িক চিত্তবিনোদনার্থে এক কাচ্চা হাস্যরস” আখ্যাপত্রের প্রতিশ্রুতি মতোই গোটা কুড়ি রম্যরচনা দিয়ে সাজানো এই ক্ষীণতনু বইটি বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসে টইটম্বুর—চিত্তবিনোদনের জন্য এক্কেবারে লাগসই সব রচনা। স্থান: কলকাতা, ভুবনেশ্বর, প্যারিস ছুঁয়ে লন্ডনে পৌঁছেছে। কাল: মোটামুটি বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত। আর রঙবেরঙের পাত্রের বিচিত্র সমাবেশে বইটি হয়ে উঠেছে যারপরনাই মুখরোচক। এই পাত্রদের মধ্যে যেমন আকর্ষণীয় অজ্ঞাতকুলশীল চরিত্ররা রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন কয়েকজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব। আর রয়েছে সরেস কিছু ঘটনার ঘনঘটা—কখনো তা ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, কখনো বা সুদূর বিলেতে। বইয়ের গোড়াতেই যাঁর কথা রয়েছে, সেই “সদা হাস্যময়ী, সুরসিকা ইংরিজি-না-জানা বিদুষী” নবীনকিশোরী দেবীই হোন, কিংবা “ভুবনেশ্বরের তৈরি ছেলে”—প্রতিটি চরিত্রের স্বল্প আঁচড়ে অনুপম বর্ণনার পাশপাশি তাদের সঙ্গে জড়িত ঘটনাগুলো এতই মুচমুচে ভঙ্গিতে পরিবেশিত, যে পাঠকের মন বহুবর্ণে রঞ্জিত হয়ে ওঠে। আদ্যন্ত বইপ্রেমী রসিক শাঁটুলবাবুর চোখে “জোড়া গির্জের নির্মল কুমার” যেমন উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেন, তেমনই আলোকিত হয়ে ওঠেন বেহালার সেই বুদ্ধিমতী যুবতী ঝি—যিনি পথ হারানো লেখককে একদিন রাতে হাত ধ’রে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। সুভো ঠাকুর, রাধারমণ মিত্তির, মুল্ক্রাজ আনন্দের মতো রথী-মহারথীদের পাশেই স্বমহিমায় উপস্থিত আইনস্টাইনের “বন্ধু”, লেখকের কমলদা কিংবা জামসেদপুর থেকে ফেরার পথে লেখক ও তাঁর সহযাত্রীদের সেই সারথি—যিনি খড়্গপুরে সহসা “উধাও” হয়ে গিয়ে সবাইকে বেশ চমকে এবং ব্যোমকে দিয়েছিলেন! সামান্য ঘটনার অসামান্য ফাঁকফোকরগুলো চিনে নিয়ে নিজের মজলিশি গদ্যে সারিবদ্ধভাবে হাজির করেছেন লেখক। কখনো ভ্রমণ, কখনো আড্ডা, কখনো অফিসের কাজ—রকমারি ক্ষেত্রে ভিন্নস্বাদের অভিজ্ঞতা ছড়িয়েছিটিয়ে আছে লেখাগুলিতে। হরেকরকম চরিত্রাবলির বৈচিত্র্য স্পর্শ করেছে বিষয়কেও। প্যারিসের খাওয়াদাওয়া নিয়ে একটি লেখায় গিরিশচন্দ্র বসুর স্মৃতিকথার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখার পাশাপাশি অন্য একটি রচনায় যেমন ‘মালাইকারি’ নামের উৎস সন্ধান করেছেন লেখক, তেমনই বঙ্কিমি লেখনীর অলিগলি ঘুরে খোঁজ পেতে চেয়েছেন ভদ্রক ও সুবর্ণরেখা নদীর আত্মীয়তার। ‘গাড়ি-হাতি-ক্যালেন্ডার’ রচনার শেষে বিজ্ঞানী সত্যেন বসু’র দিলখোলা সরল মনের এক পশলা হদিশ দেওয়ার পাশাপাশি ‘সই-সাবুদ’ রচনায় কটাক্ষ বর্ষিত হয়েছে কতিপয় জ্ঞানীগুণী বর্ষীয়ানদের বালখিল্য আচরণের প্রতি। বাংলা ভাষার ব্যবহারে অবিমৃশ্যকারিতা আর স্পনসর্ড শর্টফিল্মের কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশা নিয়েও মুচকি হাসির আড়ালে বিরক্তি উজাড় করে দিয়েছেন একজোড়া লেখায়। আর একেবারে শেষপাতে রয়েছে লেখকের লন্ডন ভ্রমণকালে বিবিসি-তে পাঠ করা দুইখান ‘লন্ডনের চিঠি’। প্রিয় হরিপদকে লেখা সেই দুই চিঠিতে বিশ শতকের এক রসিক বাঙালির চোখে সাঁটে বিলেত দর্শনের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা অতুলনীয়। সবমিলিয়ে চা বা কফি সহযোগে এক সিটিং-এ পড়ে ফেলার জন্য এমন বই দুর্দান্ত। লঘু চালে লেখা একগুচ্ছ আপাত তুচ্ছ রচনার আনাচেকানাচেই উঁকি দিয়ে যায় গভীর জীবনবোধের ঝলকানি, যার রেশটুকু থেকে যায় মনের কুঠুরিতে। বই: স্থান কাল পাত্র লেখক: রাধাপ্রসাদ গুপ্ত অলংকরণ: পূর্ণেন্দু পত্রী, রঘুনাথ গোস্বামী, শ্রীমতী রমাবাই প্রচ্ছদ: সৌম্যেন পাল প্রকাশক: সুবর্ণরেখা বিনিময়: একশত টাকা (২০১৩-র মুদ্রণ অনুযায়ী)
top of page
+91 (0) 9874827753
bottom of page